জয়পিপাসু আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটও হারাতে পারেননি ইরানকে

- আপডেট সময় : ১১:৪৩:৪০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২০ জুন ২০২৫
- / 67

“ইতিহাসের পৃষ্ঠায় যাঁর নাম অম্লান—তিনি আলেকজান্ডার। মাত্র ৩২ বছরের জীবন, অথচ শাসন করেছেন পৃথিবীর বৃহত্তম সাম্রাজ্য! যিনি পূর্ব থেকে পশ্চিমে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন একটাই বার্তা—‘আমি অজেয়!’”
খ্রিস্টপূর্ব ৩৫৬ অব্দে, গ্রিসের ম্যাসিডোনিয়া রাজ্যের রাজধানী পেল্লায় জন্ম নিলেন এক শিশু—নাম রাখা হল আলেকজান্ডার।
তার পিতা—রাজা ফিলিপ দ্বিতীয়, আর মা অলিম্পিয়াস—ছিলেন স্বপ্নদ্রষ্টা।
মায়ের মুখে শোনা হেক্টরের গল্প, আর গুরু অ্যারিস্টটলের পাঠে গড়া দৃষ্টিভঙ্গি—এই দুই মিলে জন্ম দিল বিশ্বজয়ের দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষা।
২০ বছর বয়সে পিতৃহত্যার পর, আলেকজান্ডার হলেন রাজা। শুরু হল তার অপ্রতিরোধ্য যাত্রা—এক এক করে গ্রিসের বিদ্রোহী শহরগুলোর দমন, তারপর দৃষ্টি দিলেন পারস্যের দিকে—বিশ্বজয়ের পথে!
আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট, ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সামরিক জয়ধারী, কিন্তু তার বিজয়মালার মধ্যেও ইরান তথা পারস্যের কিছু অংশ ছিল যেখানে তিনি পুরোপুরি সাফল্য পাননি। যদিও পারস্য সাম্রাজ্যের রাজা দারিয়ুস তৃতীয়কে পরাজিত করে আলেকজান্ডার এক সময় পারস্যের মূল কেন্দ্র দখল করেন, তবু আজকের আধুনিক ইরান অঞ্চলজুড়ে পুরোপুরি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি।
পারস্য সম্রাট দারিয়ুস তৃতীয়ের বিরুদ্ধে একের পর এক বিজয় অর্জনের পর আলেকজান্ডার খ্রিস্টপূর্ব ৩৩২ এ মিশরে প্রবেশ করেন। পারস্যদের কঠোর শাসনে অতিষ্ঠ মিশরীয়রা তাকে কোনও রক্তপাত ছাড়াই শান্তিপূর্ণভাবে স্বাগত জানায়।
আলেকজান্ডার শুধু একজন দখলদার ছিলেন না—তিনি রাজনীতি বুঝতেন। মিশরীয়দের ধর্ম ও সংস্কৃতিকে শ্রদ্ধা করে তিনি নিজেকে “ফ্যারাও” হিসেবে ঘোষণা করেন, যার ফলে তাকে ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে গণ্য করা হয়। এটি ছিল রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত কৌশলী সিদ্ধান্ত।
মিশরে তার সবচেয়ে স্থায়ী অবদান হলো আলেকজান্দ্রিয়া নগরীর প্রতিষ্ঠা। নীলনদের তীরে অবস্থিত এই শহরটি একসময় হয়ে ওঠে বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞানের কেন্দ্রবিন্দু। পরবর্তী কালে এটি “আলেকজান্দ্রিয়া গ্রন্থাগার” ও গবেষণাকেন্দ্রের জন্য বিখ্যাত হয়ে ওঠে।
আলেকজান্ডার জিউসের মিশরীয় রূপ “আমুন” দেবতার মন্দিরে যান সিওয়াহ মরুভূমিতে। সেখানকার পুরোহিতেরা তাকে “আমুনের পুত্র” বলে অভিহিত করে, যা তাকে ঈশ্বরতুল্য মর্যাদা দেয়। তিনি নিজেকে ‘সার্বভৌম’ ও ‘ঈশ্বরের প্রতিনিধি’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন।
আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের সাম্রাজ্য বিস্তারের সর্বশেষ সীমা ছিল ভারতবর্ষের উপকণ্ঠ। খ্রিস্টপূর্ব ৩২৬ সালে, পারস্য সাম্রাজ্য জয় করে তিনি হিন্দুকুশ পর্বতমালা অতিক্রম করে প্রবেশ করেন ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে—আজকের আফগানিস্তান ও পাকিস্তান অঞ্চলে।
হিন্দুকুশ পর্বতমালা ছিল ভৌগোলিকভাবে অত্যন্ত কঠিন অঞ্চল। কনকনে ঠান্ডা, রুক্ষ পাহাড়ি পথ, খাদ ও খাদ্য সংকট তার সৈন্যদের বিপাকে ফেলে। তবে পূর্বে বাকত্রিয়া ও সোগদিয়ানা জয় করার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আলেকজান্ডার এই পর্বত পেরোতে সক্ষম হন।
ভারতবর্ষে প্রবেশের পর তার সবচেয়ে বড় সম্মুখসমর হয় পোরাস নামক রাজন্য শাসকের সঙ্গে, যিনি তখন পাঞ্জাবের ঝেলম নদীর তীরে রাজত্ব করতেন।
সিন্ধুর তীরে এক বীর রাজাকে পেলেন প্রতিপক্ষ হিসাবে হারিয়ে দিলেন। আলেকজান্ডার বলে উঠেন, “তোমায় বন্দী করলাম রাজা, বলো—তোমার সাথে কেমন ব্যবহার করবো?” পোরাস গর্বিত স্বরেই বলে উঠেন, “যেমন একজন রাজা আরেকজন রাজার সাথে করে।” (বানান ঠিক করে দাও)
আলেকজান্ডার মুগ্ধ হলেন। পোরাসকে বন্দী না করে ফিরিয়ে দিলেন রাজত্ব। কিন্তু তার সৈন্যরা ক্লান্ত। যুদ্ধ চাইলো না আর।
এইখানেই থেমে গেল জয়যাত্রা।
৩২৩ খ্রিস্টপূর্ব, ইরাকের বাবিলন শহরে হঠাৎ জ্বরে আক্রান্ত হন আলেকজান্ডার। মাত্র ৩২ বছর বয়সে মৃত্যু হয় ইতিহাসের এক বিস্ময়পুরুষের। তিনি রেখে যান না কোনো উত্তরসূরি, না কোনো স্থায়ী কাঠামো—শুধু রেখে যান এক অমর প্রশ্ন—‘জয়ই কি শেষ সত্য?’
পারস্যে কীভাবে ব্যর্থ হলেন আলেকজান্ডার? এ প্রশ্ন যখন সবার মনে, তখন ঐতিহাসিকরা কয়েকটি মূল কারণ বের করেছেন। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে, ভৌগোলিক প্রতিবন্ধকতা: ইরানের পূর্বাঞ্চল ও পার্বত্য অঞ্চলগুলোতে যুদ্ধ চালানো ছিল অত্যন্ত কঠিন। পাহাড়ি গেরিলা কৌশল ও প্রতিকূল আবহাওয়া তার সেনাবাহিনীর অগ্রযাত্রাকে মন্থর করে দেয়।
স্থানীয় বিদ্রোহ ও প্রতিরোধ: পারস্য সাম্রাজ্যের পতনের পরেও অনেক স্থানীয় শাসক ও জনগণ তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। বিশেষ করে বাকত্রিয়ার মতো অঞ্চলে বিদ্রোহ বারবার ঘটে।
আলেকজান্ডার চেষ্টা করেছিলেন পারস্য সংস্কৃতিকে গ্রহণ করে পারস্যবাসীর হৃদয় জয় করার। তিনি পারস্য নারীদের বিয়ে করেন এবং পারস্যদেরকে প্রশাসনে অন্তর্ভুক্ত করেন। কিন্তু এই মিশ্রনীতি গ্রিক সেনাবাহিনীর মধ্যে অসন্তোষ তৈরি করে।
দীর্ঘ অভিযানে ক্লান্ত সৈনিকদের নিয়ে ইরানের গভীর অভ্যন্তরে প্রবেশ করা আলেকজান্ডারের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। তার সেনারা বারবার দেশে ফেরার দাবি তোলে।
আলেকজান্ডার পারস্যের মূল রাজধানী পার্সেপোলিস দখল করলেও পুরো ইরান ভূখণ্ডের ওপর একক কর্তৃত্ব স্থায়ী করতে পারেননি। তার মৃত্যুর পর সেই অঞ্চলগুলো আবার স্বাধীনভাবে বা বিভিন্ন ডায়াডোকদের শাসনে ফিরে যায়।
ইরান-ইসরায়েলের সাম্প্রতিক যুদ্ধ উত্তেজনার মধ্যেই চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং বলেছেন, মহাবীর আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটও ইরানকে পরাজিত করতে পারেননি। ঐতিহাসিকভাবে এটাই সত্য যে, আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের জয়পিপাসু জীবনের অন্যতম ব্যর্থতা পারস্যকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা।
One thought on “জয়পিপাসু আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটও হারাতে পারেননি ইরানকে”