ঢাকা ০১:০১ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১০ জুলাই ২০২৫, ২৫ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সাত কারণে যুদ্ধে হারবে না ইরান

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
  • আপডেট সময় : ১০:২৮:৪৪ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৮ জুন ২০২৫
  • / 72

ইরান-ইসরায়েল

দৈনিক দেশ আমার অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

ইসরায়েল কখনো কল্পনাও করেনি, ইরানের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে এত বড় প্রতিরোধের মুখে পড়তে হবে। রাজধানী তেলআবিবের কিছু অংশে ইরানের হামলা এমন ছিল যে, অনেকের কাছে তা গাজা মনে হয়েছে। এখন প্রশ্ন উঠছে—ইরান ও ইসরায়েল কি আরও বড় আকারের যুদ্ধে জড়াবে? যুক্তরাষ্ট্র কি তাতে সরাসরি যুক্ত হবে? ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান কি হার মানবে?

বিশ্লেষকদের মতে, ইরানের কিছু গভীর কৌশলগত শক্তি আছে, যার কারণে দেশটিকে পরাজিত করা প্রায় অসম্ভব। নিচে এমন ৭টি কারণ তুলে ধরা হলো, যেগুলো ইরানকে একটি অজেয় রাষ্ট্রে পরিণত করেছে।

১. হরমুজ প্রণালি: বিশ্ব জ্বালানির নিয়ন্ত্রণ
ইরানের সবচেয়ে বড় শক্তি সামরিক নয়, বরং ভৌগোলিক। দক্ষিণ সীমান্তঘেঁষা হরমুজ প্রণালি বিশ্বের অন্যতম কৌশলগত সমুদ্রপথ। মাত্র ৩৩ কিলোমিটার চওড়া এই পথ দিয়ে বিশ্বের প্রায় ২০% তেল পরিবাহিত হয়। বিশ্লেষকরা একে ‘বিশ্ব অর্থনীতির রক্তনালি’ বলে অভিহিত করেন। এই প্রণালির আশপাশের সাতটি দ্বীপ ইরানের নিয়ন্ত্রণে, যা একে অতুলনীয় ভূ-রাজনৈতিক সুবিধা দেয়। হরমুজ প্রণালি বন্ধ করার হুমকি দিলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে পশ্চিমা বিশ্বে।

২. তিন মহাদেশের সংযোগস্থলে অবস্থান
ইরান ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার সংযোগস্থলে অবস্থিত। এর সঙ্গে রয়েছে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ জলসীমা: উত্তরে কাস্পিয়ান সাগর, দক্ষিণে পারস্য উপসাগর ও ওমান উপসাগর। এই ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যই ইরানকে মধ্যপ্রাচ্যের কেন্দ্রে এনে দাঁড় করিয়েছে। গত পাঁচ শতাব্দী ধরে একই সীমানায় টিকে থাকা বিরল রাষ্ট্রগুলোর একটি ইরান। ইতিহাসজুড়ে বহু পরাশক্তি ইরানকে দখলের চেষ্টা করলেও সবাই ব্যর্থ হয়েছে।

৩. উন্নত ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন প্রযুক্তি
ইরান মুসলিম বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে দূরপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করেছে, যার রেঞ্জ ২,০০০ কিলোমিটার পর্যন্ত। এসব ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েল থেকে শুরু করে ইউরোপের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতেও আঘাত হানতে সক্ষম। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল কমান্ড স্বীকার করেছে, মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ভাণ্ডার সবচেয়ে আধুনিক ও বৃহৎ। পাশাপাশি, ইরান স্বল্প খরচে অত্যাধুনিক ড্রোন তৈরি করে দুনিয়াজুড়ে আলোচনায় এসেছে। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে এই ড্রোন ব্যবহার করে সাফল্য পেয়েছে।

৪. পাহাড় ও মরুভূমিতে সুরক্ষিত দুর্গ
ইরান প্রাকৃতিকভাবে একটি দুর্গসম দেশ। পশ্চিম ও দক্ষিণ সীমান্তে রয়েছে জাগরোস পর্বতমালা, আর উত্তরে আলবোর্জ পর্বতমালা—যা বহিরাগতদের অগ্রযাত্রা কঠিন করে তোলে। এছাড়া রয়েছে ভয়াবহ গরমের অঞ্চল ‘লুত মরুভূমি’, যেখানে সৈন্য ও রসদ পাঠানো প্রায় অসম্ভব। এই ভৌগোলিক প্রতিরক্ষা কাঠামো দেশটিকে আক্রমণ প্রতিরোধে শক্তিশালী অবস্থানে রাখে।

৫. তেলের নিচে অর্থনৈতিক শক্তি
বিশ্বের মোট প্রমাণিত প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রায় ১৫% এবং খনিজ তেলের ১০% মজুত রয়েছে ইরানে। এই বিপুল সম্পদ দেশটিকে অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সুবিধা দেয়। বিশেষ করে হরমুজ প্রণালি ও অন্যান্য রপ্তানি পথের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকায় বিশ্ব তেলের দামে প্রভাব ফেলতে পারে ইরান।

৬. রাশিয়া-চীনের সমর্থন
যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা ও হুমকিকে উপেক্ষা করে ইরান রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করেছে। ইসরায়েলের সঙ্গে সাম্প্রতিক উত্তেজনার পর থেকে এই দুই পরাশক্তির কূটনৈতিক ও নিরাপত্তাগত সহায়তা ইরান পেয়েছে। এমনকি রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও ইরানকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছে বলে ধারণা করা হয়, যা ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড় হুমকি।

৭. ছায়াযুদ্ধ ও ‘প্রক্সি’ শক্তি
ইরানের সবচেয়ে কৌশলগত অস্ত্র এর প্রক্সি নেটওয়ার্ক—‘অক্ষ অব প্রতিরোধ’। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ইরান সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে রয়েছে ফিলিস্তিনের হামাস, লেবাননের হিজবুল্লাহ, সিরিয়ার ফাতেমিয়ুন ব্রিগেড, ইরাকের আল-বদর ও ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা। এদের মাধ্যমে ইরান সরাসরি যুদ্ধে না গিয়ে অঞ্চলজুড়ে চাপ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়।

প্রাচীন পারস্য থেকে আজকের ইরান—হাজার বছরের ইতিহাসে দেশটি বহুবার আক্রমণের শিকার হয়েছে, কিন্তু কখনো দখলদারদের শাসন মেনে নেয়নি। ভবিষ্যতেও এই ধারা বজায় থাকবে কিনা, তা সময়ই বলে দেবে। তবে একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, ইরানকে দমন করা বা হারানো সহজ নয়।

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য

সাত কারণে যুদ্ধে হারবে না ইরান

আপডেট সময় : ১০:২৮:৪৪ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৮ জুন ২০২৫

ইসরায়েল কখনো কল্পনাও করেনি, ইরানের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে এত বড় প্রতিরোধের মুখে পড়তে হবে। রাজধানী তেলআবিবের কিছু অংশে ইরানের হামলা এমন ছিল যে, অনেকের কাছে তা গাজা মনে হয়েছে। এখন প্রশ্ন উঠছে—ইরান ও ইসরায়েল কি আরও বড় আকারের যুদ্ধে জড়াবে? যুক্তরাষ্ট্র কি তাতে সরাসরি যুক্ত হবে? ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান কি হার মানবে?

বিশ্লেষকদের মতে, ইরানের কিছু গভীর কৌশলগত শক্তি আছে, যার কারণে দেশটিকে পরাজিত করা প্রায় অসম্ভব। নিচে এমন ৭টি কারণ তুলে ধরা হলো, যেগুলো ইরানকে একটি অজেয় রাষ্ট্রে পরিণত করেছে।

১. হরমুজ প্রণালি: বিশ্ব জ্বালানির নিয়ন্ত্রণ
ইরানের সবচেয়ে বড় শক্তি সামরিক নয়, বরং ভৌগোলিক। দক্ষিণ সীমান্তঘেঁষা হরমুজ প্রণালি বিশ্বের অন্যতম কৌশলগত সমুদ্রপথ। মাত্র ৩৩ কিলোমিটার চওড়া এই পথ দিয়ে বিশ্বের প্রায় ২০% তেল পরিবাহিত হয়। বিশ্লেষকরা একে ‘বিশ্ব অর্থনীতির রক্তনালি’ বলে অভিহিত করেন। এই প্রণালির আশপাশের সাতটি দ্বীপ ইরানের নিয়ন্ত্রণে, যা একে অতুলনীয় ভূ-রাজনৈতিক সুবিধা দেয়। হরমুজ প্রণালি বন্ধ করার হুমকি দিলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে পশ্চিমা বিশ্বে।

২. তিন মহাদেশের সংযোগস্থলে অবস্থান
ইরান ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার সংযোগস্থলে অবস্থিত। এর সঙ্গে রয়েছে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ জলসীমা: উত্তরে কাস্পিয়ান সাগর, দক্ষিণে পারস্য উপসাগর ও ওমান উপসাগর। এই ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যই ইরানকে মধ্যপ্রাচ্যের কেন্দ্রে এনে দাঁড় করিয়েছে। গত পাঁচ শতাব্দী ধরে একই সীমানায় টিকে থাকা বিরল রাষ্ট্রগুলোর একটি ইরান। ইতিহাসজুড়ে বহু পরাশক্তি ইরানকে দখলের চেষ্টা করলেও সবাই ব্যর্থ হয়েছে।

৩. উন্নত ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন প্রযুক্তি
ইরান মুসলিম বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে দূরপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করেছে, যার রেঞ্জ ২,০০০ কিলোমিটার পর্যন্ত। এসব ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েল থেকে শুরু করে ইউরোপের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতেও আঘাত হানতে সক্ষম। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল কমান্ড স্বীকার করেছে, মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ভাণ্ডার সবচেয়ে আধুনিক ও বৃহৎ। পাশাপাশি, ইরান স্বল্প খরচে অত্যাধুনিক ড্রোন তৈরি করে দুনিয়াজুড়ে আলোচনায় এসেছে। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে এই ড্রোন ব্যবহার করে সাফল্য পেয়েছে।

৪. পাহাড় ও মরুভূমিতে সুরক্ষিত দুর্গ
ইরান প্রাকৃতিকভাবে একটি দুর্গসম দেশ। পশ্চিম ও দক্ষিণ সীমান্তে রয়েছে জাগরোস পর্বতমালা, আর উত্তরে আলবোর্জ পর্বতমালা—যা বহিরাগতদের অগ্রযাত্রা কঠিন করে তোলে। এছাড়া রয়েছে ভয়াবহ গরমের অঞ্চল ‘লুত মরুভূমি’, যেখানে সৈন্য ও রসদ পাঠানো প্রায় অসম্ভব। এই ভৌগোলিক প্রতিরক্ষা কাঠামো দেশটিকে আক্রমণ প্রতিরোধে শক্তিশালী অবস্থানে রাখে।

৫. তেলের নিচে অর্থনৈতিক শক্তি
বিশ্বের মোট প্রমাণিত প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রায় ১৫% এবং খনিজ তেলের ১০% মজুত রয়েছে ইরানে। এই বিপুল সম্পদ দেশটিকে অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সুবিধা দেয়। বিশেষ করে হরমুজ প্রণালি ও অন্যান্য রপ্তানি পথের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকায় বিশ্ব তেলের দামে প্রভাব ফেলতে পারে ইরান।

৬. রাশিয়া-চীনের সমর্থন
যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা ও হুমকিকে উপেক্ষা করে ইরান রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করেছে। ইসরায়েলের সঙ্গে সাম্প্রতিক উত্তেজনার পর থেকে এই দুই পরাশক্তির কূটনৈতিক ও নিরাপত্তাগত সহায়তা ইরান পেয়েছে। এমনকি রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও ইরানকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছে বলে ধারণা করা হয়, যা ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড় হুমকি।

৭. ছায়াযুদ্ধ ও ‘প্রক্সি’ শক্তি
ইরানের সবচেয়ে কৌশলগত অস্ত্র এর প্রক্সি নেটওয়ার্ক—‘অক্ষ অব প্রতিরোধ’। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ইরান সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে রয়েছে ফিলিস্তিনের হামাস, লেবাননের হিজবুল্লাহ, সিরিয়ার ফাতেমিয়ুন ব্রিগেড, ইরাকের আল-বদর ও ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা। এদের মাধ্যমে ইরান সরাসরি যুদ্ধে না গিয়ে অঞ্চলজুড়ে চাপ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়।

প্রাচীন পারস্য থেকে আজকের ইরান—হাজার বছরের ইতিহাসে দেশটি বহুবার আক্রমণের শিকার হয়েছে, কিন্তু কখনো দখলদারদের শাসন মেনে নেয়নি। ভবিষ্যতেও এই ধারা বজায় থাকবে কিনা, তা সময়ই বলে দেবে। তবে একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, ইরানকে দমন করা বা হারানো সহজ নয়।