পাহাড় জুড়ে উৎসবের আমেজ

- আপডেট সময় : ১২:১৪:০৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৩ এপ্রিল ২০২৫ ১৯ বার পড়া হয়েছে

“সাংগ্রাইমা ঞিঞি ঞাঞা হির্কেজেহ পাহমে”—অর্থাৎ “বৈসাবি আসছে, চলো একসাথে মৈত্রীবর্ষণে মাতি”—এই মধুর আহ্বানে মুখরিত হয়ে উঠেছে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিটি কোণা। পাহাড়ি জনপদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব মাহা সাংগ্রাই পোয়ে ঘিরে শুরু হয়েছে বর্ণিল উৎসবের আমেজ।
বান্দরবানসহ তিন পার্বত্য জেলায় মাসব্যাপী চলা এই উৎসব উপলক্ষে পাহাড়ের প্রতিটি গ্রাম এখন সাজানো হয়েছে আলোকসজ্জা আর ঐতিহ্যবাহী সাজে। আজ থেকে শুরু হওয়া আনুষ্ঠানিকতার অংশ হিসেবে আয়োজিত হয় বর্ণাঢ্য মঙ্গল শোভাযাত্রা, যেখানে অংশ নেন পাহাড়ের ১১টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষ।
সকালে বান্দরবানের ঐতিহ্যবাহী রাজার মাঠে জমায়েত হন মারমা, চাকমা, ম্রো, বম, খুমি, ত্রিপুরাসহ নানা সম্প্রদায়ের মানুষ। রঙিন পোশাকে, হাতে ব্যানার আর মুখে উচ্ছ্বাস নিয়ে তারা অংশ নেন শোভাযাত্রায়, যা এক অনন্য সাংস্কৃতিক মিলনমেলায় রূপ নেয়।
উৎসবের উদ্বোধন করেন জেলা প্রশাসক শামিম আরা রিনি। তার সঙ্গে ছিলেন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটের পরিচালক নুক্রাচিং মারমা, পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য কেএস মং মারমা, সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মারুফা সুলতানা খান হীরামনি এবং উৎসব উদযাপন পরিষদের সভাপতি চনু মং মারমা।
শোভাযাত্রা শেষে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটে আয়োজন করা হয় বয়োজ্যেষ্ঠ পূজা। সেখানে উপস্থিত বয়োজ্যেষ্ঠদের মাঝে মোমবাতি, আগরবাতি, দেশলাই, ফলমূল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী তুলে দেন আয়োজকরা।

এই উৎসব উপলক্ষে ১৩ থেকে ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত সপ্তাহব্যাপী নানা আয়োজন রেখেছে উদযাপন কমিটি। ১৪ এপ্রিল বিহারে দায়ক-দায়িকাদের উদ্দেশ্যে আহার দান ও অর্থ সহায়তা, বিকেলে বুদ্ধস্নান এবং রাতে পিঠা তৈরির উৎসব হবে। ১৫ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হবে ঐতিহ্যবাহী বলী খেলা ও তৈলাক্ত বাঁশে আরোহনের মতো আকর্ষণীয় প্রতিযোগিতা। ১৬ থেকে ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত চলবে মৈত্রী পানি বর্ষণ আর ঐতিহ্যবাহী পোশাকে সাংস্কৃতিক পরিবেশনা।
এই উৎসবকে ঘিরে পাহাড়ের মানুষের অনুভূতিও ভীষণ ইতিবাচক। পিয়াল বম, বম সম্প্রদায়ের তরুণী বলেন, “সব জাতিগোষ্ঠী একসাথে মিলিত হওয়ায় খুব ভালো লাগছে। অতীতের দুঃখ ভুলে আমরা এক নতুন বছর শুরু করতে চাই।”
চংক্রি ম্রো, ম্রো তরুণ বলেন, “আমরা চাংক্রান বলি এই উৎসবকে। সবাই মিলে আনন্দ ভাগ করে নিচ্ছি।”
হ্লাহ্লা সিং মারমা, মারমা তরুণী বলেন, “সাংগ্রাই পোয়ে আমাদের ঐতিহ্যের প্রতীক। একে অপরকে পানিতে ভিজিয়ে পুরনো দুঃখ মুছে দিয়ে নতুন বছরকে বরণ করা আমাদের সংস্কৃতি।”
জেলা প্রশাসক শামিম আরা রিনি বলেন, “পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর বৈচিত্র্য আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। সাংগ্রাই উৎসব আমাদের ঐক্য ও সৌহার্দ্যের প্রতীক। পারস্পরিক সম্মান আর সম্প্রীতির মধ্য দিয়ে এই আনন্দ আরও বিস্তৃত হোক—এই প্রত্যাশাই করি।”
বান্দরবানে শুরু হওয়া মাহা সাংগ্রাই উৎসব কেবল ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বরং এটি পাহাড়ি সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও সহাবস্থানের এক চমৎকার প্রতিফলন। এই উৎসব পাহাড়ের প্রতিটি মানুষকে এক সুতোয় বেঁধে, আনন্দ-ভ্রাতৃত্ব ও শান্তির বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছে সর্বত্র।