ঢাকা ০৯:৩৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৫, ১৫ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

বাংলাদেশে শিশু হত্যার ভয়াবহ চিত্র

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • আপডেট সময় : ১২:২৬:৩৭ অপরাহ্ন, রবিবার, ৬ এপ্রিল ২০২৫ ৩৪ বার পড়া হয়েছে

শিশু হত্যা (প্রতীকী ছবি)

দৈনিক দেশ আমার অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

চলতি বছরের শুরুতেই বাংলাদেশে শিশু হত্যার ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর তথ্যমতে, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে ৭০ জন শিশু হত্যার শিকার হয়েছে, অর্থাৎ গড়ে প্রতিদিন একটি শিশুর প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন এবং সংগঠনের নিজস্ব তথ্যভান্ডারের ভিত্তিতে এই পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হয়।

মানবাধিকার কর্মী ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুদের প্রতি সহিংসতা এখন ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে। শুধু হত্যাই নয়, জীবিত ও মৃত নবজাতকদের পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া যাচ্ছে, যা মানবিকতার জন্য গভীর চ্যালেঞ্জ। তারা মনে করেন, দেশে শিশু সুরক্ষায় কঠোর আইন থাকলেও কার্যকর বাস্তবায়ন ও বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে অপরাধীরা ভয়হীন হয়ে উঠছে।

মানবাধিকার সংগঠন ও সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞজনের মতে, দেশে আশঙ্কাজনকভাবে শিশু হত্যার ঘটনা ঘটছে-একই সঙ্গে জীবিত ও মৃত নবজাতককে পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া যাচ্ছে যা অমানবিক ও নিন্দনীয় বলে মন্তব্য করেন তারা। তারা বলেন, শিশুদের প্রতি সহিংসতা রোধে দেশে যথেষ্ট কঠোর আইন থাকা সত্ত্বেও অপরাধ দমন ও নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্টদের কার্যকর ভূমিকার অভাব, বিচারহীনতা, বিচারের দীর্ঘসূত্রতা অপরাধীদের বেপরোয়া করে তুলেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নেতিবাচক দায়িত্ববোধ, ত্বরিত পদক্ষেপ নিতে অপারগতার ফলে শিশুদের প্রতি সহিংসতা যে হারে বেড়ে চলেছে তা জাতীয় জীবনে অন্যতম প্রধান উদ্বেগ হিসেবে দেখা দিয়েছে। মোবাইল আসক্তি, বাবা-মায়ের পরকীয়া, সম্পত্তিতে অধিকার, পারিবারিক শত্রুতা-এমন নানা কারণে শিশু হত্যার ঘটনাগুলো ঘটছে। পরিবার ও রাষ্ট্রে গুরুত্ব হারাচ্ছে শিশু, উপেক্ষিত শিশু অধিকার। শিশুর বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যকর ভূমিকা নিশ্চিত ও রাষ্ট্রের ভূমিকা নিশ্চিতে গুরুত্বারোপ করেন তারা।

বছরের প্রথম তিন মাসের কিছু মর্মান্তিক ঘটনা:
২ এপ্রিল, গাজীপুর: সৎ-মায়ের হাতে তিশা মনি (২) নামের এক শিশুর মৃত্যুর অভিযোগে সৎ-মা গ্রেপ্তার।

২৬ ফেব্রুয়ারি, নারায়ণগঞ্জ: অপহরণের এক দিন পর ৯ বছরের বাইজিদের মরদেহ উদ্ধার। মুক্তিপণ হিসেবে দাবি করা হয়েছিল ৫০ হাজার টাকা।

৬ ফেব্রুয়ারি, মৌলভীবাজার: ১১ বছর বয়সী পূর্ণিমা রেলীর গলাকাটা ও হাত বিচ্ছিন্ন মরদেহ উদ্ধার। নিখোঁজ ছিল আগের দিন বিকেলে।

এদিকে, মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ)-এর তথ্য মতে, জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত মোট ৭৮ শিশু হত্যা করার তথ্য পাওয়া যায়। ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে ৩৩ জন শিশু হত্যা করা হয়। এ সময়ে আরো সাত জন মৃত নবজাতক শিশুকে দেশের বিভিন্ন স্থানে পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া গেছে। ফেব্রুয়ারি মাসে তিন জন শিশু, ছয় জন নারীর অস্বাভাবিক মৃত্যুসহ মোট ২৬ জন শিশু হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। মার্চে ধর্ষণ ও হত্যা করা হয় তিন শিশুকে, এছাড়াও উক্ত মাসে ছয় জন শিশুর অস্বাভাবিক মৃত্যুসহ মোট ১৯ জন শিশু হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়। এ সময়ে পাঁচ জন মৃত নবজাতক শিশুকে দেশের বিভিন্ন স্থানে পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া গেছে, যা অমানবিক ও নিন্দনীয় বলছে সংগঠনটি। এসব শিশুকে কী কারণে পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া যাচ্ছে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তা নিরূপণের চেষ্টা করছে না-আইন ও সালিশ কেন্দ্রের উপদেষ্ঠা মাবরুক মোহাম্মদ বলেন, হত্যার ঘটনাগুলোকে বিচারিক পক্রিয়ার মধ্যমে নেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু জটিলতা দেখা যায়। গৃহশ্রমিক হত্যা হলে আপোষ করা হয়। দরিদ্র শ্রেণির শিশু হত্যা হলে প্রভাবশালীরা মামলা না নিতে পুলিশকে প্রভাবিত করে। মামলা হলে দীর্ঘদিন চলে বলে সাক্ষী পাওয়া যায় না। প্রমাণ থাকেনা। এসব কারণ ছাড়াও হত্যার ঘটনাগুলো ঘটলে তার ওপর ফলোআপ না থাকায় শেষ পর্যন্ত কী হয় তাও জানা যায় না বলে মন্তব্য করেন তিনি।

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইফ সায়েন্স অনুষদের ডিন ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্সের শিক্ষক জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ উমর ফারুক বলেন, বিচার কার্যকর করতে দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ-প্রথমত বিচার পক্রিয়ার জটিলতা দূর করতে হবে। দ্বিতীয়ত বাব-মা ও রাষ্ট্রর দায়িত্ব পালন নিশ্চিত করা। বাবা-মায়ের কারণে শিশু হত্যা হলে সে মামলা টেকে না। গবেষণায় দেখা যায়, পারিবারিক পরিস্থিতি, শিশু পরিচর্যা ও প্রতিবেশী, স্কুল ও নিকট আত্মীয়র মতো প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিশুর প্রতি মমত্ববোধ ও মর্যাদা সম্মান কমে আসছে। অনেক ক্ষেত্রে শিশুকে বোঝা মনে করাও হচ্ছে। শিশুকে নিরাপত্তা দিতে এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে সংস্কার করতে হবে। পাশপাশি পরিবার ও রাষ্ট্রকে শিশুর আইনি ও সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের ধারণা শিশুর সকল দায়িত্ব পরিবারের, কিন্তু শিশুর নিরাপত্তার মূল দায়িত্ব রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র সেই দায়িত্ব পালন করছে না। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় নামমাত্র কিছু কাজ করছে।

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য

বাংলাদেশে শিশু হত্যার ভয়াবহ চিত্র

আপডেট সময় : ১২:২৬:৩৭ অপরাহ্ন, রবিবার, ৬ এপ্রিল ২০২৫

চলতি বছরের শুরুতেই বাংলাদেশে শিশু হত্যার ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর তথ্যমতে, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে ৭০ জন শিশু হত্যার শিকার হয়েছে, অর্থাৎ গড়ে প্রতিদিন একটি শিশুর প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন এবং সংগঠনের নিজস্ব তথ্যভান্ডারের ভিত্তিতে এই পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হয়।

মানবাধিকার কর্মী ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুদের প্রতি সহিংসতা এখন ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে। শুধু হত্যাই নয়, জীবিত ও মৃত নবজাতকদের পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া যাচ্ছে, যা মানবিকতার জন্য গভীর চ্যালেঞ্জ। তারা মনে করেন, দেশে শিশু সুরক্ষায় কঠোর আইন থাকলেও কার্যকর বাস্তবায়ন ও বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে অপরাধীরা ভয়হীন হয়ে উঠছে।

মানবাধিকার সংগঠন ও সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞজনের মতে, দেশে আশঙ্কাজনকভাবে শিশু হত্যার ঘটনা ঘটছে-একই সঙ্গে জীবিত ও মৃত নবজাতককে পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া যাচ্ছে যা অমানবিক ও নিন্দনীয় বলে মন্তব্য করেন তারা। তারা বলেন, শিশুদের প্রতি সহিংসতা রোধে দেশে যথেষ্ট কঠোর আইন থাকা সত্ত্বেও অপরাধ দমন ও নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্টদের কার্যকর ভূমিকার অভাব, বিচারহীনতা, বিচারের দীর্ঘসূত্রতা অপরাধীদের বেপরোয়া করে তুলেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নেতিবাচক দায়িত্ববোধ, ত্বরিত পদক্ষেপ নিতে অপারগতার ফলে শিশুদের প্রতি সহিংসতা যে হারে বেড়ে চলেছে তা জাতীয় জীবনে অন্যতম প্রধান উদ্বেগ হিসেবে দেখা দিয়েছে। মোবাইল আসক্তি, বাবা-মায়ের পরকীয়া, সম্পত্তিতে অধিকার, পারিবারিক শত্রুতা-এমন নানা কারণে শিশু হত্যার ঘটনাগুলো ঘটছে। পরিবার ও রাষ্ট্রে গুরুত্ব হারাচ্ছে শিশু, উপেক্ষিত শিশু অধিকার। শিশুর বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যকর ভূমিকা নিশ্চিত ও রাষ্ট্রের ভূমিকা নিশ্চিতে গুরুত্বারোপ করেন তারা।

বছরের প্রথম তিন মাসের কিছু মর্মান্তিক ঘটনা:
২ এপ্রিল, গাজীপুর: সৎ-মায়ের হাতে তিশা মনি (২) নামের এক শিশুর মৃত্যুর অভিযোগে সৎ-মা গ্রেপ্তার।

২৬ ফেব্রুয়ারি, নারায়ণগঞ্জ: অপহরণের এক দিন পর ৯ বছরের বাইজিদের মরদেহ উদ্ধার। মুক্তিপণ হিসেবে দাবি করা হয়েছিল ৫০ হাজার টাকা।

৬ ফেব্রুয়ারি, মৌলভীবাজার: ১১ বছর বয়সী পূর্ণিমা রেলীর গলাকাটা ও হাত বিচ্ছিন্ন মরদেহ উদ্ধার। নিখোঁজ ছিল আগের দিন বিকেলে।

এদিকে, মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ)-এর তথ্য মতে, জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত মোট ৭৮ শিশু হত্যা করার তথ্য পাওয়া যায়। ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে ৩৩ জন শিশু হত্যা করা হয়। এ সময়ে আরো সাত জন মৃত নবজাতক শিশুকে দেশের বিভিন্ন স্থানে পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া গেছে। ফেব্রুয়ারি মাসে তিন জন শিশু, ছয় জন নারীর অস্বাভাবিক মৃত্যুসহ মোট ২৬ জন শিশু হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। মার্চে ধর্ষণ ও হত্যা করা হয় তিন শিশুকে, এছাড়াও উক্ত মাসে ছয় জন শিশুর অস্বাভাবিক মৃত্যুসহ মোট ১৯ জন শিশু হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়। এ সময়ে পাঁচ জন মৃত নবজাতক শিশুকে দেশের বিভিন্ন স্থানে পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া গেছে, যা অমানবিক ও নিন্দনীয় বলছে সংগঠনটি। এসব শিশুকে কী কারণে পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া যাচ্ছে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তা নিরূপণের চেষ্টা করছে না-আইন ও সালিশ কেন্দ্রের উপদেষ্ঠা মাবরুক মোহাম্মদ বলেন, হত্যার ঘটনাগুলোকে বিচারিক পক্রিয়ার মধ্যমে নেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু জটিলতা দেখা যায়। গৃহশ্রমিক হত্যা হলে আপোষ করা হয়। দরিদ্র শ্রেণির শিশু হত্যা হলে প্রভাবশালীরা মামলা না নিতে পুলিশকে প্রভাবিত করে। মামলা হলে দীর্ঘদিন চলে বলে সাক্ষী পাওয়া যায় না। প্রমাণ থাকেনা। এসব কারণ ছাড়াও হত্যার ঘটনাগুলো ঘটলে তার ওপর ফলোআপ না থাকায় শেষ পর্যন্ত কী হয় তাও জানা যায় না বলে মন্তব্য করেন তিনি।

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইফ সায়েন্স অনুষদের ডিন ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্সের শিক্ষক জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ উমর ফারুক বলেন, বিচার কার্যকর করতে দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ-প্রথমত বিচার পক্রিয়ার জটিলতা দূর করতে হবে। দ্বিতীয়ত বাব-মা ও রাষ্ট্রর দায়িত্ব পালন নিশ্চিত করা। বাবা-মায়ের কারণে শিশু হত্যা হলে সে মামলা টেকে না। গবেষণায় দেখা যায়, পারিবারিক পরিস্থিতি, শিশু পরিচর্যা ও প্রতিবেশী, স্কুল ও নিকট আত্মীয়র মতো প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিশুর প্রতি মমত্ববোধ ও মর্যাদা সম্মান কমে আসছে। অনেক ক্ষেত্রে শিশুকে বোঝা মনে করাও হচ্ছে। শিশুকে নিরাপত্তা দিতে এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে সংস্কার করতে হবে। পাশপাশি পরিবার ও রাষ্ট্রকে শিশুর আইনি ও সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের ধারণা শিশুর সকল দায়িত্ব পরিবারের, কিন্তু শিশুর নিরাপত্তার মূল দায়িত্ব রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র সেই দায়িত্ব পালন করছে না। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় নামমাত্র কিছু কাজ করছে।