একুশের চেতনায় শান্তি ফিরুক বাংলাদেশে

- আপডেট সময় : ১২:০২:৫৮ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২১ ফেব্রুয়ারী ২০২৫ ১৬ বার পড়া হয়েছে

ফেব্রুয়ারি মানেই বাঙালির গৌরবের মাস, আত্মত্যাগের মাস। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষার অধিকার রক্ষায় বুকের তাজা রক্ত ঝরিয়ে যে অধ্যায় রচনা করেছিল বাঙালি, তা শুধু একদিনের ঘটনা নয়; এটি আমাদের জাতীয় চেতনার ভিত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভাষা আন্দোলনের সেই চেতনাই পরবর্তীতে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন এবং ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রেরণা হয়ে ওঠে। তাই একুশে ফেব্রুয়ারি কেবল ভাষার জন্য আত্মত্যাগের দিন নয়, এটি আমাদের জাতীয় ঐক্য, গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার এবং মানবাধিকারের প্রতীক।
১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান বিভক্তির পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বৈষম্যের শিকার হতে থাকে। বিশেষ করে, সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা বাংলা থাকা সত্ত্বেও উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার অপচেষ্টা চালানো হয়। বাঙালিরা এর প্রতিবাদে রাস্তায় নামে, যার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ নাম না জানা আরও অনেক তরুণ প্রাণ উৎসর্গ করেছিল মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। তাদের আত্মত্যাগের ফলে ১৯৫৬ সালে বাংলা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি পায়।
পরবর্তীতে, একুশের চেতনা শুধু ভাষার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি; এটি আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের সোপান হয়ে ওঠে। ১৯৭১ সালে বাঙালিরা একই চেতনা ধারণ করে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং রক্তের বিনিময়ে একটি স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে।
একুশের চেতনার মূল বার্তা ছিল গণতন্ত্র, সাম্য, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার এবং অসাম্প্রদায়িকতা। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশে আমরা কি সত্যিই সেই চেতনাকে ধারণ করতে পেরেছি?
আজকের বাংলাদেশ রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্নীতি, সামাজিক বিভক্তি ও বৈষম্যের শিকার। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ দুর্বল হয়ে পড়ছে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত হচ্ছে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনা ঘটছে, আর ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমন করার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
একুশের চেতনা ছিল সাম্য ও ন্যায়বিচারের। কিন্তু দেশে ধনী-গরিবের বৈষম্য প্রকট হচ্ছে। রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়ন না হওয়ায় সাধারণ জনগণের হতাশা বাড়ছে। আবার শিক্ষার মানোন্নয়নের পরিবর্তে বাণিজ্যিকীকরণ চলছে, যা একুশের চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
শান্তি প্রতিষ্ঠায় করণীয়:
বাংলাদেশকে যদি সত্যিকার অর্থে একুশের চেতনায় গড়ে তুলতে হয়, তাহলে আমাদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে হবে—
১. গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে— মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে মানুষ নির্ভয়ে নিজের কথা বলতে পারে।
২. শিক্ষার মানোন্নয়ন ও ভাষার মর্যাদা রক্ষা— বাংলা ভাষার সঠিক ব্যবহার ও প্রচলন নিশ্চিত করতে হবে, পাশাপাশি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষায় গুরুত্ব দিতে হবে।
৩. সামাজিক সাম্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা— ধনী-গরিব বৈষম্য কমিয়ে সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করতে হবে।
৪. সহিষ্ণুতা ও রাজনৈতিক সৌহার্দ্য বৃদ্ধি— প্রতিহিংসার রাজনীতি বন্ধ করে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও গণতান্ত্রিক চর্চাকে উৎসাহিত করতে হবে।
৫. আইনের শাসন নিশ্চিত করা— বিচার ব্যবস্থার স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে হবে, যাতে অপরাধীরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পায় এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়।
একুশ আমাদের শিখিয়েছে আত্মত্যাগ, ন্যায়বিচার এবং অধিকার আদায়ের লড়াই। ভাষা আন্দোলনের সেই চেতনা আজও প্রাসঙ্গিক, কারণ ন্যায়, সমতা ও মানবাধিকারের জন্য লড়াই আজও শেষ হয়নি। আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব হলো একুশের চেতনাকে শুধু প্রতীকীভাবে নয়, বাস্তব জীবনেও ধারণ করা। তাহলেই বাংলাদেশ সত্যিকারের শান্তি ও প্রগতির পথে এগিয়ে যেতে পারবে। একুশের চেতনায় আলোকিত হোক আমাদের ভবিষ্যৎ, শান্তি ফিরে আসুক বাংলাদেশে।
লেখক: সম্পাদক, দৈনিক দেশ আমার