বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিসরে সংসদ নির্বাচন ঘিরে একটি নতুন বিতর্ক ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে, দেশে প্রচলিত ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ ব্যবস্থার পরিবর্তে ‘আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব’ বা ‘প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন’ (পিআর) পদ্ধতি চালু হবে কিনা, এ নিয়ে। রাজনৈতিক দলগুলোর ভিন্নমত এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় অমিল পরিস্থিতিকে আরও অনিশ্চিত করে তুলছে।
মতপার্থক্যের কেন্দ্রে যে ইস্যু
বিএনপি এই পিআর পদ্ধতির ঘোর বিরোধী। তাদের ভাষ্যে, এই পদ্ধতির আলোচনা মূলত নির্বাচন পেছানোর কৌশল মাত্র। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিস, গণঅধিকার পরিষদসহ কয়েকটি দল এই পদ্ধতির পক্ষে অবস্থান নিচ্ছে। ফলে রাজনৈতিক অঙ্গনে এক ধরনের উত্তেজনা তৈরি হয়েছে।
কী এই পিআর পদ্ধতি?
বর্তমানে বাংলাদেশে ৩০০টি আসনে সরাসরি ভোটে একক প্রার্থী নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদ গঠিত হয়। পিআর পদ্ধতিতে এই ব্যবস্থার পরিবর্তে আসন বণ্টন হয় দলগুলোর মোট ভোটের আনুপাতিক হারে। অর্থাৎ কোনো দল যদি ১০% ভোট পায়, তারা পাবে সংসদের ১০% আসন, যা হবে ৩০টি।
পিআর পদ্ধতির তিনটি ধরন রয়েছে:
মুক্ত তালিকা পদ্ধতি: ভোটের ভিত্তিতে দলভুক্ত প্রার্থীদের মধ্য থেকে নির্বাচন
বদ্ধ তালিকা পদ্ধতি: দল পূর্বনির্ধারিতভাবে সদস্য ঠিক করে
মিশ্র পদ্ধতি (এমএমপি): কিছু আসনে একক প্রার্থী নির্বাচন, কিছুতে পিআর
রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান
পিআর ব্যবস্থাকে অচেনা, জটিল এবং জনপ্রতিনিধিত্ববিরোধী আখ্যা দিয়েছে। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, সাধারণ ভোটার জানে না পিআর পদ্ধতি কী। তারা ব্যক্তিকেন্দ্রিক ভোট দিয়ে প্রতিনিধি নির্বাচন করতে চায়। এ ধরনের বিদেশি ধারণা বাংলাদেশের মানুষের বাস্তবতায় খাপ খায় না।
স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, এই পিআর আলোচনা নির্বাচন বিলম্বিত করার ষড়যন্ত্র।
পিআরপন্থী দলসমূহের যুক্তি:
জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিসসহ কয়েকটি দল বলছে, পিআর পদ্ধতিতে ভোট কারচুপি, কালো টাকা, কেন্দ্র দখল কমে আসবে। প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে আসন ভাগ হলে সব দলের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হবে।
ইসলামী আন্দোলনের গাজী আতাউর রহমান বলেন, ফ্যাসিবাদ ঠেকাতে পিআর পদ্ধতি সবচেয়ে কার্যকর।
খেলাফত মজলিস নতুন একটি প্রস্তাব দিয়েছে: মিক্সড মেম্বার পিআর (এমএমপি ) পদ্ধতি। দলটির আমির মামুনুল হক বলছেন, প্রচলিত পদ্ধতি এবং পিআর দুয়ের দুর্বলতা মোকাবেলায় এই তৃতীয় পথ হতে পারে সর্বোত্তম সমাধান।
বাস্তবতা ও তুলনা
পিআর পদ্ধতির সমর্থনে দলগুলো ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচন ফলাফলকে তুলে ধরেছে। উদাহরণস্বরূপ: ২০০১ সালে বিএনপি ৪০.৮৬% ভোটে পেয়েছিল ১৯৩ আসন। একই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৪০.২২% ভোটে পেয়েছিল মাত্র ৬২টি আসন।
২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ৪৮.০৪% ভোটে ২৩০টি আসন পেয়েছিল, আর বিএনপি ৩২.৫০% ভোট পেয়ে মাত্র ৩০টি আসন।
পিআর পদ্ধতি থাকলে এমন পার্থক্য হতো না, এটাই তাদের যুক্তি।
পিআরবিরোধী দলগুলোর শঙ্কা
তারা মনে করে, পিআর চালু হলে ব্যক্তির বদলে দল নেতৃত্ব ঠিক করবে। ফলে এমপি ও ভোটারের সরাসরি সম্পর্ক থাকবে না। ঝুলন্ত সংসদ তৈরি হতে পারে, এমনকি ছোট দলগুলোর অল্প ভোটে প্রভাব অসামঞ্জস্যপূর্ণ বা অনুপাতহীন হয়ে যাবে।
নিবন্ধিত দলগুলোর পরিসংখ্যান
বর্তমানে দেশে নিবন্ধিত দল ৫০টি (আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত)।
১৮টি দল পিআর পদ্ধতির পক্ষে
২৮টি দল বিপক্ষে
৪টি দল অবস্থান স্পষ্ট করেনি
নিবন্ধিত নয় এমন কিছু নতুন উদীয়মান দল যেমন জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) পিআর পদ্ধতির প্রবল সমর্থক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, “বাংলাদেশে পিআর বাস্তবায়নের তিনটি শর্ত; বড় আঞ্চলিক দল, ফেডারেল কাঠামো এবং বিস্তৃত রাজনৈতিক বৈচিত্র্যের কোনোটিই নেই। পিআর চালু করলে আরও জটিলতা বাড়বে।”
তাঁর মতে, বর্তমান প্রেক্ষাপটে পিআর নিয়ে বিতর্ক অব্যাহত থাকলে নির্বাচন প্রক্রিয়া দুর্বল হবে, প্রশাসনিক কাঠামো জটিল হবে, এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়বে।
পিআর পদ্ধতি এখন কেবল একটি নির্বাচনী ইস্যু নয়, বরং এটি হয়ে উঠছে রাজনৈতিক টানাপোড়েন ও কৌশলগত অবস্থান নির্ধারণের অংশ। একদিকে নতুন ব্যবস্থার প্রস্তাব, অন্যদিকে ভোটার-প্রার্থী সংযোগের বাস্তবতা, এই দুইয়ের মাঝে অবস্থান করছে বাংলাদেশের গণতন্ত্র।
সংলাপ ও রাজনৈতিক ঐকমত্য ছাড়া নির্বাচন পদ্ধতির প্রশ্নে সিদ্ধান্ত নেওয়া আগামী নির্বাচনের জন্য আরও বড় সংকট তৈরি করতে পারে; এমনটাই বলছেন বিশ্লেষকরা।
প্রকাশক: মো. আরমান শরীফ
সম্পাদক: জিললুর রহমান চৌধুরী
নির্বাহী সম্পাদক: মোঃ মনিরুল ইসলাম
অফিস: বাসা: ২৭, রোড: ৭/ডি, সেক্টর :৯, উত্তরা মডেল টাউন
ই-মেইল: octopusy2816@gmail.com